ফুটবল দুনিয়ার ইতিহাসে ক্লাব ও খেলোয়াড়ের মধ্যে সবচেয়ে আবেগঘন সম্পর্কগুলোর একটি হলো বার্সেলোনা ও লিওনেল মেসির বন্ধন। এই সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক ইতি টানা হয় ২০২১ সালের ৮ আগস্ট। কিন্তু সম্পর্ক শেষ হলেও আর্থিক দায় থেকে যায়। সেই দায়ই চার বছর পর শেষ করতে যাচ্ছে বার্সেলোনা। ক্লাবটির পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে, ২০২৪ সালের ৩০ জুন তারা মেসির বকেয়া বেতনের শেষ কিস্তি পরিশোধ করবে।
কেন এই বকেয়া?
২০২০ সালের গোড়ায় পুরো বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়। এই সময় বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যসহ ক্রীড়াঙ্গনও স্থবির হয়ে পড়ে। ক্লাবগুলোর আয়ের প্রধান উৎস, যেমন ম্যাচ ডে রেভিনিউ, টিভি সম্প্রচার এবং স্পন্সরশিপ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বার্সেলোনা—যারা তখন ভীষণ আর্থিক সংকটে—তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় মেসির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসে। সমঝোতা অনুযায়ী মেসি তাঁর বেতনের একটি বড় অংশ স্থগিত রাখতে রাজি হন, যাতে ক্লাবটি আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
চুক্তি নবায়নে ব্যর্থতা এবং মেসির বিদায়
২০২১ সালে যখন মেসির সঙ্গে নতুন চুক্তি করার কথা ওঠে, তখন বার্সেলোনা জানান যে তারা আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা করতে পারছে না। লা লিগার অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের কারণে চুক্তি নবায়ন সম্ভব হয়নি এবং সেই পরিস্থিতিতে মেসিকে বাধ্য হয়ে ক্লাব ছাড়তে হয়। এর পরপরই তিনি প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি)-তে যোগ দেন এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামির হয়ে খেলছেন।
কত টাকা বকেয়া ছিল?
বিভিন্ন কিস্তিতে বার্সেলোনা মেসির বকেয়া অর্থ পরিশোধ করে আসছে। শেষ কিস্তিটি বাকি ছিল ৫৯.৫০ লাখ ইউরো, যা তারা ২০২৪ সালের ৩০ জুন পরিশোধ করবে বলে জানিয়েছে। এই কিস্তির পর বার্সেলোনার পক্ষ থেকে মেসির প্রতি আর কোনো আর্থিক দায় থাকবে না।
শুধু মেসি নন, বাকি আরও তারকারাও বেতন পাননি
মেসির মতোই আরও কিছু সিনিয়র খেলোয়াড়ও বার্সেলোনার কাছে বকেয়া বেতন পেতেন। তাঁদের মধ্যে আছেন সের্হিও বুসকেতস এবং জর্দি আলবা—বর্তমানে যারা মেসির সঙ্গেই ইন্টার মায়ামিতে খেলছেন।
-
বুসকেতস পাচ্ছেন ১১.৮ লাখ ইউরো
-
আলবা পাচ্ছেন ৯.৪৩ লাখ ইউরো
তাঁদের এই অর্থও ৩০ জুন পরিশোধ করার কথা রয়েছে।
বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যেও কেউ কেউ বেতন পাননি
করোনা মহামারির সময় যারা ক্লাবে ছিলেন এবং এখনো আছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ স্থগিত বেতন পাননি। যেমন:
-
পেদ্রি পাচ্ছেন ৭.৫৭ লাখ ইউরো
-
রোনালদ আরাউহো পাচ্ছেন ৪.২৯ লাখ ইউরো
এই অর্থগুলোও একই দিনে পরিশোধ করা হবে।
অন্যদিকে, মার্ক–আন্দ্রে টের স্টেগান এবং ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং বেতন স্থগিত করতে রাজি হননি। তাঁরা বরং নিজেদের চুক্তির শর্ত পুনর্বিন্যাস করে নতুনভাবে চুক্তি করেন।
কেন এই পরিশোধ এখন?
২০২৪–২৫ অর্থবছরের শেষ দিনে ক্লাব হিসাববিজ্ঞান অনুযায়ী সব আর্থিক দায় পরিশোধ করে রাখতে হয়। বার্সেলোনাও চাইছে তাদের হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার রাখতে, যাতে ভবিষ্যতের ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে বা লা লিগার সালারি ক্যাপ নিয়ে সমস্যা না হয়। সেই দিক থেকেই মেসির বকেয়া বেতন পরিশোধ শুধু আবেগের নয়, বরং অর্থনৈতিক বাস্তবতার অংশও।
সম্পর্কের নতুন অধ্যায়?
যদিও মেসি এখন বার্সেলোনার খেলোয়াড় নন, তবে তাঁর সঙ্গে ক্লাবের সম্পর্ক এখনো অনেকটাই আবেগনির্ভর। ক্লাব প্রেসিডেন্ট হোয়ান লাপোর্তা বারবার বলেছেন, “মেসি আমাদের সন্তান, কখনোই তাকে ভুলা যাবে না।”
ভবিষ্যতে মেসিকে বার্সার দূত, কোচিং স্টাফ বা অন্য কোনো ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যেতে পারে—এমন গুঞ্জনও জোরালো। এই বকেয়া পরিশোধ সেই সম্ভাবনার পথকেও কিছুটা মসৃণ করতে পারে।
লিওনেল মেসি ও বার্সেলোনার সম্পর্ক শুধু মাঠের পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধ ছিল না; ছিল পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বন্ধন। করোনাকালীন সংকটে মেসি ক্লাবকে সহায়তা করেছিলেন আর্থিকভাবে। সেই বন্ধনের প্রতিদান হিসেবে অবশেষে বার্সেলোনা তাঁর প্রতি আর্থিক দায় শেষ করতে যাচ্ছে।
এই ঘটনা শুধু একটি ক্লাব ও খেলোয়াড়ের সম্পর্কের সমাপ্তি নয়, বরং একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি, যা ভবিষ্যতে নতুন সম্পর্কের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। লিওনেল মেসির মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের সঙ্গে এমন পরিণতি—যেখানে সব দায়বদ্ধতা পূরণ হয়—সেটিই ফুটবল ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
1 thought on “মেসি র বকেয়া পাওনা পরিশোধ করছে বার্সেলোনা: চার বছর পর শেষ হচ্ছে আর্থিক সম্পর্ক”