ইজেকুয়েল লাভেজ্জি, আধুনিক ফুটবলে অনেক ফুটবলারের নাম আমরা প্রতিনিয়ত শুনি, কেউ রেকর্ড গড়ে, কেউ ট্রফি জিতে, কেউবা তারকা খ্যাতির শীর্ষে। তবে এমন কিছু ফুটবলার আছেন যাদের পরিসংখ্যান যতটা না বড়, হৃদয়ে তাদের জায়গা ঠিক ততটাই গভীর। আর্জেন্টিনার জার্সিতে এমনই একজন নাম ইজেকুয়েল লাভেজ্জি। মেসির যুগে তার সবচেয়ে অবিচল ও নিবেদিত সহযোদ্ধাদের একজন, যার নাম আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেই না।
মেসির বর্তমান যুগের ডি পল, অতীতের লাভেজ্জি
বর্তমানে আর্জেন্টিনা দলে রড্রিগো ডি পল মেসির পাশে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো এক যোদ্ধা। মাঝমাঠে দ্বিগুণ দৌড়ঝাঁপ করে, ফাউল খায়, জায়গা তৈরি করে—সব কিছু করে একটাই উদ্দেশ্যে, মেসিকে ফ্রিডম দেওয়া। কিন্তু এমন একজন আগেও ছিলেন। সময়টা ২০১৪ বিশ্বকাপের, নাম তার ইজেকুয়েল লাভেজ্জি। সাবেলার স্কোয়াডে ইজেকুয়েল লাভেজ্জির জায়গা ছিল মেসির ঠিক পেছনের স্তম্ভ হয়ে। উইং ধরে তার দৌড়, ডিফেন্সে তার ওয়ার্করেট, আক্রমণে মেসিকে জায়গা করে দেওয়ার তার চেষ্টাই তাকে আলাদা করে তোলে।
লাভেজ্জির ট্যাকটিকাল গুরুত্ব: আগুয়েরোর জায়গায় জায়গা
২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম কয়েকটি ম্যাচে দেখা যায়, আগুয়েরো নিয়মিত একাদশে থাকলেও ইনজুরি ও ফর্মের কারণে সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ইজেকুয়েল লাভেজ্জি ছিলেন কোচ সাবেলার প্রথম পছন্দ। লাভেজ্জির কাজ ছিল মেসির পেছনে জায়গা তৈরি করা, প্রতি আক্রমণে ডানদিক কভার করা এবং ডিফেন্সে গিয়েও অবদান রাখা। এই রোলের কারণে মেসিকে আরও কেন্দ্রীভূতভাবে খেলার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। লাভেজ্জির এমন স্কিলসেট ও দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ফাইনালে পৌঁছানো আর্জেন্টিনার এক গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী করে তোলে।
কাল্ট হিরো হয়ে ওঠার পেছনের কারণ
ইজেকুয়েল লাভেজ্জি কখনও বড় তারকা ছিলেন না। তার গোল সংখ্যা খুব বেশি নয়, ট্রফি ক্যাবিনেট অন্যদের মতো নয়। কিন্তু তিনি ছিলেন সেই যোদ্ধাদের একজন যাদের দেখে মনে হতো, তারা দেশ আর দলের জন্য নিঃস্বার্থভাবে সব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। পিএসজি ও নাপোলির হয়ে ক্লাব ক্যারিয়ারেও তিনি ভিন্ন আলোয় জ্বলেছেন। বিশেষ করে নাপোলিতে তার খেলা তাকে ইউরোপিয়ান ফুটবলে পরিচিত করে তোলে। পরে পিএসজিতে প্রাইম কাটালেও তিনি কখনো অতিরিক্ত লাইমলাইটে আসেননি, বরং নিজের কাজটুকু করে গেছেন নীরবে।
৩ ফাইনালের ট্র্যাজেডি: ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা
ইজেকুয়েল লাভেজ্জির ক্যারিয়ার সবচেয়ে বেশি চিহ্নিত হয়ে থাকবে তার আর্জেন্টিনা ক্যারিয়ারের সেই তিন ফাইনাল দিয়ে—২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল, ২০১৫ কোপা আমেরিকা ফাইনাল এবং ২০১৬ কোপা আমেরিকা সেন্টেনারিও ফাইনাল। তিনটি ফাইনালেই আর্জেন্টিনা হারে এবং লাভেজ্জিও ছিলেন সেই দুঃখের অংশীদার। বারবার শিরোপার দোরগোড়ায় গিয়ে ফিরে আসা এই দলটির এক অবিচ্ছেদ্য সদস্য ছিলেন তিনি।
ক্যারিয়ারের ট্র্যাজিক ইনজুরি ও বিদায়
২০১৬ কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে একাদশে থাকা অবস্থায় বলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে মাঠের পাশে থাকা বিজ্ঞাপন বোর্ডে ধাক্কা খান ইজেকুয়েল লাভেজ্জি। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যায় তার। সেটিই ছিল তার আর্জেন্টিনার হয়ে শেষ ম্যাচ। ট্র্যাজিক হলেও বাস্তব এই যে, সেই ইনজুরির পর তিনি আর কখনো জাতীয় দলে ফিরে আসেননি।
চোখের সামনে বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা, কোপা আমেরিকার টানা দুটি ফাইনাল খেলা, এবং শেষে এক ইনজুরিতে ক্যারিয়ারের অবসান—এটাই ছিল লাভেজ্জির জাতীয় দলের পরিণতি।
গোলের সংখ্যা নয়, ভালোবাসার গভীরতা
ইজেকুয়েল লাভেজ্জি আর্জেন্টিনার হয়ে করেছেন মাত্র ৯টি গোল। কিন্তু তার করা গোলের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য তার দৌড়, তার পরিশ্রম, এবং দলীয় কৌশলে নিজের ভূমিকাকে গ্রহণ করার মানসিকতা। তার শেষ গোলটিও এসেছিল সেই ইনজুরির ম্যাচে। সেটাই ছিল তার জাতীয় দলের বিদায়ী ম্যাচ। অনেকে হয়তো আজ তার নাম মনে রাখেনি, কিন্তু যারা ২০১০-এর দশকের আর্জেন্টিনাকে অনুসরণ করেছেন, তাদের হৃদয়ে লাভেজ্জি চিরস্থায়ী হয়ে আছেন।
ক্লাব ক্যারিয়ারে উজ্জ্বলতা
জাতীয় দলের বাইরে লাভেজ্জির ক্লাব ক্যারিয়ারও ছিল বেশ উজ্জ্বল। নাপোলিতে তার স্কিল ও পেস দলে নতুন প্রাণ নিয়ে আসে। এরপর পিএসজিতে তিনি তার প্রাইম কাটান, যেখানে ইব্রাহিমোভিচ, কাভানি ও ভারাত্তির মতো তারকাদের সঙ্গে খেলেছেন। সে সময় ফরাসি লিগে তার খেলা আর্জেন্টিনার অনেক সমর্থক নিয়মিত ফলো করতো, শুধুমাত্র লাভেজ্জির কারণে।
২০১৯ সালে চায়নার হেবেই চায়না ফরচুন ক্লাবের হয়ে খেলা অবস্থায় ৩৩ বছর বয়সে তিনি পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেন।
লাভেজ্জি: এক নস্টালজিয়ার নাম
আজ যখন আমরা ডি পল-এর মতো মেসির বর্তমান সহযোদ্ধাদের দেখি, তখন মনে পড়ে যায় সেইসব পুরনো সৈনিকদের, যারা মেসির দুঃখের দিনে সাথ দিয়েছিল। লাভেজ্জি তাদেরই একজন। সেইসব দিনের একজন প্রতিনিধি, যখন আর্জেন্টিনা ফাইনালে গিয়ে ফিরে আসতো খালি হাতে, কিন্তু মাঠে লড়ে যাওয়া একদল নিবেদিত সৈনিক সমর্থকদের হৃদয় জয় করতো।
ইজেকুয়েল লাভেজ্জি হয়তো পরিসংখ্যানে বিখ্যাত নন, কিন্তু যারা সত্যিকারের ফুটবল বোঝে, তারা জানে এমন কিছু ফুটবলার আছেন যারা দলে না থাকলে তারকারাও আলো ছড়াতে পারতো না। মেসি হয়তো ইতিহাসের সেরা ফুটবলার, কিন্তু তাকে ঘিরে দাঁড়ানো ভালোবাসা, বিশ্বাস আর লড়াইয়ের প্রতীকদের একজন ছিল ইজেকুয়েল লাভেজ্জি। সময় হয়তো তার নাম ভুলে যাবে, কিন্তু নস্টালজিয়ায় ভরা হৃদয়ে লাভেজ্জি বেঁচে থাকবেন একজন ট্রাজিক হিরো হিসেবে।