ক্রুইফের বিপ্লবী চরিত্রের কথা সবারই জানা। ধনী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের প্রস্তাব রিজেক্ট করে আর্থিক দূরাবস্থার বার্সায় যোগদানের কথাও সবার জানা। চলুন জানা যাক, ক্রুইফের আরেক চরিত্র — “জেদী” চরিত্র নিয়ে।
ক্রুইফ আয়াক্সের সন্তান, আয়াক্সই তার ঘর আজীবনের জন্যে তিনি তাই ই মনে করতেন। নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে আয়াক্সকে পর পর তিনবার এনে দেন ইউরোপীয়ান শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। তবে একটা সময় ক্রুইফ একটু ঘুরতে বের হন পৃথিবী। বার্সেলোনা থেকে শুরু করে লস এঞ্জেলস, লেভান্তে, ওয়াশিংটন ডিপ্লোম্যাটসে খেলে ক্রুইফ আবারো ফিরে আসেন তার ঘর আয়াক্সে।
৩৪ বছর বয়সে ক্রুইফ আয়াক্সে আসার পর ক্লাবের কাছ থেকে পান ২ বছরের চুক্তি। ১৯৮৩ সালের ঘটনা, ক্রুইফের চুক্তির শেষ দিক। শিরোপার খুব কাছে আয়াক্স, হেসেখেলেই জিতলো লীগ শিরোপা। ক্রুইফ দিনক্ষণ গুনছেন আয়াক্স কবে আবার তাকে প্রস্তাব দেয় আরো ২/১ বছর আয়াক্সে কাটানোর জন্যে।
তবে ক্লাব কর্তারা ভেবে রেখেছিলো ক্রুইফকে তারা ৩৬ বছর বয়সে একটা ভালো বিদায় দেবেন, তাই তাকে আর দেননি কোনো চুক্তির অফার। ক্রুইফ একদম শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরেও যখন আয়াক্স তার কাছে কোনো অফার নিয়ে যায়নি, তখন বেজায় বেকে বসেন তিনি। গল্পের টুইস্টের শুরু এখান থেকেই।
রেগে বেকে বসা ক্রুইফ যোগ দেন আয়াক্সের চিরপ্রতীন্দ্বন্দ্বী ক্লাব ফেয়েনুর্দে। প্রথমত ক্রুইফকে ফেয়েনুর্দে দেখে পুরো নেদারল্যান্ডবাসী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ঘরের ছেলে এভাবে ঘর ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিতেই পারে, কিন্তু একেবারে রাইভাল দলে? এমনটা ভাবনাতেও আসেনি তাদের। রাগে অন্ধ হয়ে এমনটাই করেছিলেন ক্রুইফ।
জ্যাক ট্রুস্ট ছিলেন ফেয়েনুর্দের ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’। ক্রুইফের ছায়ায় থেকে পরবর্তীতে নেদারল্যান্ড সেরা হওয়া ট্রুস্টের ভাষ্যমতে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল ফেয়েনুর্দের খেলোয়াড়েরাও। ট্রুস্টের ভাষায়, ‘তাঁর ফেয়েনুর্দে আসার একটাই কারণ ছিল, আয়াক্স বোর্ডকে দেখিয়ে দেওয়া। যে তিনি এখনও তাঁর সেরা সময়ে আছেন। ১০ বছর ইরিদিভিস না জেতা ক্লাবকে একমাত্র তিনিই জেতাতে পারেন।’
৩৭ এ পা দেওয়া ক্রুইফ কি ই বা করতে পারেন একটা দলের জন্যে? তবে মেডিকেল পরীক্ষার পর দেখা যায় দলের অধিকাংশ ফুটবলারের তুলনায় এখনো যথেষ্ট ফিট তিনি। দলে যোগ দিয়ে অন্যদেরও করতে থাকেন চাঙ্গা। নিজে খেলার মাঝে অন্যদেরও দিতে থাকেন মোটিভেশান। কিন্তু উদ্দীপনা দিয়েই তো আর শিরোপা জেতা সম্ভব নয়। বরং নিজের আইডিয়াগুলোই খাটাতে শুরু করলেন ফেয়েনুর্দের জার্সিতে।
সমস্যা বাধলো অন্য জায়গায়। ক্রুইফ নিজের ফিলোসোফি বপন করে এসেছিলেন আয়াক্সে, সেখান থেকে আবার গজাতে শুরু করেছে চারা। এরই মধ্যে আবার দরজায় কড়া নাড়ছে ক্লাসিকোর ঘন্টা। অন্যদিকে, ফেয়েনুর্দের খেলোয়াড়দের মধ্যে এখনো বীজ বপনই শেষ করতে পারেননি ক্রুইফ।
১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩; আয়াক্স বনাম ফেয়েনুর্দ। প্রথমবারের মত রাইভালের জার্সি গায়ে আয়াক্সের বিপক্ষে নামছেন ক্রুইফ। শুধু ক্রুইফ বললে অবশ্য ভুল হবে, প্রতিশোধের আগুনে ফুটতে থাকা জোহান ক্রুইফ। ম্যাচ শেষে ফলাফল? আয়াক্স ৮-২ ফেয়েনুর্দ! ক্রুইফের দল পাত্তাই পায়নি আয়াক্সের কাছে।
ম্যাচ শেষে ক্রুইফ কী করেছিলেন? বলেছিলেন, ১-০ হোক আর ৮-২ হোক; হারিয়েছি ঐ ৩ পয়েন্টই! এখন সময় সামনে তাকানোর। পরের ক্লাসিকো আসতে না আসতেই পুরো পাশার দান উল্টে দিয়েছিলেন ক্রুইফ। এবার রোটারডামে আয়াক্স মুখোমুখি এক নতুন ফেয়েনুর্দের। এই দলে বপন করা বীজ থেকে চারাগাছ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। বাকি ছিল শুধু আয়াক্সের বুকে ছোঁড়া প্রবেশ করানোর।
২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, ডে কাইপ, ক্রুইফের প্রতিশোধের দিন। ৫৮ হাজার দর্শকের সামনে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আয়াক্সকে উড়িয়ে দিলেন নিজের হাতে গড়া দল ফেয়েনুর্দ। ১২ মিনিটে গুলিতকে দিয়ে করালেন প্রথম গোল, পরের দুই মিনিটেই নিজেই জড়ালেন বল জালে। এরপর আন্দ্রে হোকস্ট্রা ও হ্যাঙ্ক ডুট মিলে করলেন আরও দুই গোল হলো এক হালি।
আয়াক্স যাকে ‘বুড়ো’ বলে দরজার বাইরে পাঠিয়েছিল, সেই ক্রুইফই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখালেন তিনি শেষ নন, তিনি কিংবদন্তি। সেদিনই লিগ শিরোপা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ২৫ জয়, মাত্র ২ হার আর ৫৭ পয়েন্ট নিয়ে ১০ বছর পর ফেয়েনুর্দ জিতে নেয় লিগ ও লীগ কাপ দুটোই। আর আয়াক্স? ছিটকে পড়ে দেখে কেবল আফসোস।
জেদ যখন রুপ নেয় আত্মবিশ্বাসে, তখনই মানুষ লিখে ফেলতে পারে এমন ইতিহাস। ক্রুইফরা অবশ্য শুধুই মানব না, ফুটবলের মহামানব। যাদের হাত ধরেই লেখা হয় এমন অবিশ্বাস্য রুপকথার গল্প।