“সিংহহৃদয় সেই মানুষটা থেমে গেলেন – বিদায় ভার্ডি”

লেস্টার সিটি প্রিমিয়ার লিগ থেকে রেলিগেট হচ্ছে, জেমি ভার্ডি ১৩ বছর পর লেস্টারশায়ার ছাড়ছে – মেসি-রোনালদো, পেদ্রী-গুলার , রাফিনহা – এম্বাপে না; আজকের শিরোনাম জেমি ভার্ডি। লেস্টার সিটির মহানায়ক!

শৈশবে রূপকথার গল্প শোনানো হয় আমাদের, কৈশোরের প্রথম দিনগুলোতেই এই ফেয়ারি টেইল বাবল চুপসে দিয়ে বলা হয়, ” জীবন কোনো রূপকথা নয়।”

কিন্তু রূপকথার গল্প বাস্তবে এক্সিস্ট করে, অন্তত কমপক্ষে ১০ বছর আগে ফুটবলকে ভালবেসে বেড়ে ওঠা একটা প্রজন্মের কাছে তো করেই। তাঁরা ক্লদিও রানিয়েরির লেস্টার সিটিকে দেখেছে, দেখেছে জেমি রিচার্ড ভার্ডি নামের এক সিংহহৃদয় মহামানবকে – যার আগ্রাসন সমুদ্রের উত্তাল স্রোতের মতো বয়ে গিয়েছিল ব্রিটেনের উপর দিয়ে।

জেমি রিচার্ড ভার্ডির জীবনের গল্পটা অদ্ভুত। শুনতে যতটা ভালো লাগে, নিজেকে ভার্ডির জায়গায় রেখে দিলে ততটা খারাপ লাগে। জেমি ভার্ডির জায়গায় থাকলে স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিয়ে দিতাম অনেক আগেই।

ইয়র্কশায়ার কাউন্টির শেফিল্ডে জন্ম। দুধের শিশুকে রেখে বাবা চলে যায়। শেষ নামটা পর্যন্ত সৎ বাবার কাছে থেকে ইনহেরিট করা। শেফিল্ড ওয়েন্সডে ফ্যান হয়ে বেড়ে ওঠা। বয়স যখন ১৬, তখন ভালবাসার ক্লাব শেফিল্ড তাঁকে রিলিজ করে দেয়, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল ভার্ডির।

পিতৃহারা, খেটে খাওয়া মায়ের সন্তানের কাছে ফুটবল ছিলো জীবনের দুস্মৃতি ভুলে থাকার একমাত্র উপায়। ভার্ডি তাই ফুটবলের উপর গিভ আপ করলেন না, যেমন তার বাবা করেছিলো তাঁর মায়ের উপর, তাঁর উপর। অর্থের তাগিদে কারখানায় কাজ নিলেন কারখানায়। সপ্তাহজুড়ে হাড়ভাঙা খাটনির পর ছুটির দিনে ফুটবল খেলতেন, অষ্টম বিভাগে, নন – লিগ ফুটবল।

নিত্যদিনের এই দমবন্ধ রুটিন তাঁকে ফ্রাস্ট্রেটেড করে দিয়েছিল একটা সময়। আর্লি টুয়েন্টিসে জীবনকে উপভোগ করার কথা। তাঁর সমবয়সীরা যখন ব্রাজিলে গিয়ে নিজের দেশকে বিশ্বকাপে রিপ্রেজেন্ট করছে, তখনও তিনি ইয়র্কশায়ারে রোবটের মত কার্বন ফাইবার নামাচ্ছেন কারখানায় দাঁড়িয়ে। একদিন বারে গিয়ে ফিস্ট ফাইটে জড়িয়ে পড়লেন, পুলিশের নজর এড়িয়ে গেলো না। ক্লাবের হয়ে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলে নিষেধাজ্ঞা এলো।

দুধের বয়স থেকে দুঃখ যার নিত্যসঙ্গী, জীবনের সেই মানুষটার জন্য মায়া হলো। ২৫ বছর পেরোনোর পর গল্পটা শুধু সাফল্যের, একের পর এক বিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাধে ছুটে চলার।

অষ্টম , পঞ্চম বিভাগ থেকে একটা বড়সড় লিপ নিয়ে সরাসরি চ্যাম্পিয়নশিপে। যার উপর কেউ ভরসা করতে পারেনি, লেস্টার তাঁকে শুধু ভরসা করেনি , ভালবেসে কাছে টেনে নিয়েছিল রীতিমতো। ভালবাসার কাঙাল ভার্ডি লেস্টারের কাছে তাই চিরঋণী হয়ে থাকলো।

প্রথমে লেস্টারকে প্রিমিয়ার লিগে নিয়ে এলো চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে। প্রিমিয়ার লিগে অবনমন হতে হতে বেঁচে গেলো প্রথমবার। ইংল্যান্ডের টপ ফ্লাইট ফুটবলের স্বাদ পেয়ে ভার্ডি হিংস্র হয়ে উঠলো।

ইতালি ফেরত ক্লদিও রানিয়েরি নামের এক গুরুর শিষ্যত্ব নিলো ভার্ডি, মাহরেজ, কান্তের মতো আউটকাস্টরা; যাদের সারাজীবন আন্ডারএস্টিমেট করে যাওয়া হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ফুটবল – এই টার্মকে ইতালিয়ান ভদ্রলোকের দল বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গেলো – একবার না, বারবার!

পাগলাটে ইংলিশম্যান ভার্ডি নিজেকে চেনালেন, ভিন্নভাবে। তাঁর গতির ঝড়, খু*নে অগ্রাসন, গোলার মতো শট, উদ্বাহু উদযাপন সাধারণের ভিড়ে তাঁকে ব্যতিক্রম করে রাখলো।

লেস্টার চেলসি, আর্সেনাল, সিটি, ইউনাইটেড, টটেনহ্যাম, লিভারপুলকে পেছনে ফেলে লিগ জিতলো, জন্ম হলো লেস্টার রূপকথার। আনডিজয়ারেবল থেকে আনডিনায়েবল হয়ে গেলেন ভার্ডি। বড়বড় ক্লাব থেকে অফার এলো। মাহরেজ চলে গেলেন সিটিতে, কান্তে – ড্রিঙ্কওয়াটার চেলসিতে কিন্তু জেমি ভার্ডি বললেন, ” লেস্টার আমাকে তখন চেয়েছিল, যখন কেউ আমাকে চায়নি। তাই আমি লেস্টার ছাড়তে পারবো না।”

সৃষ্টিকর্তাও তাঁকে দুহাত ভরে দিলো। ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপ খেললেন, লেস্টারকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নেতৃত্ব দিলেন। ২০২১ সালে এফএ কাপ জিতলেন, ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে এফএ কাপের প্রত্যেকটা রাউন্ডে খেলার নজির গড়লেন।

সব ফেয়ারী টেইলের দি এন্ড হয়। লেস্টার আর ভার্ডির গল্পেরও দি এন্ড হলো। প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমন, আবার ফিরে আসা, এরপর আবার অবনমন।

শুধু মাঝে রয়ে গেলো ভার্ডির করা ১৪৫ প্রিমিয়ার লিগ গোল, প্রিমিয়ার লিগের অল টাইম চার্টে ১৫ নম্বরে জেমি রিচার্ড ভার্ডির নামটা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু একজন প্রিমিয়ার লীগ ভেটারান বার্কলেইসম্যান, কাল্ট হিরোকে কি শুধু স্ট্যাট দিয়ে মাপা যায়?

আমার কাছে তিনি ইতিহাসের সেরা। ত্রিশ পেরিয়েও প্রতিটা দিন লড়েছেন লেস্টারের ব্যাজের জন্য। এই মানুষটা সাউথ ইয়র্কশায়ারের ছোট ক্লাবটাকে ডানা মেলতে শিখিয়েছেন, বুড়ো – বুড়িদের জন্য নতুন রূপকথার গল্প রেখে গিয়েছেন, ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরোনোর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

প্রিমিয়ার লিগে হাজারটা প্লেয়ার আসবে কিন্তু সিংহহৃদয় জেমি ভার্ডির মত কেউ ইংলিশ ফুটবলকে ওন করতে পারবে না। এই মৌসুমের শেষ ১৩ বছরের লেস্টার – ভার্ডি সম্পর্কের ইতি ঘটছে।

৩৮ এ এসে ভার্ডি থামলেন। লেস্টার আবার কবে প্রিমিয়ার লিগে ফিরবে, জানিনা। জেমি ভার্ডি ছাড়া এই পথটা বন্ধুর। একটা কথা নিশ্চিত – ইংলিশ ফুটবলে এরকম অর্গানিক মেগাস্টার আর আসবেনা অন্তত।

 

Leave a Comment